সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড : ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল চার বছর আগেই


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪, ২:০৩ অপরাহ্ন
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড :  ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল চার বছর আগেই

সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ২০১৯ সালের শেষ দিকে সরজমিনে পরীক্ষা চালিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। এ প্রতিবেদন প্রকাশ হয় ২০২০ সালের শুরুর দিকে। ওই প্রতিবেদনে সচিবালয়ের বেশ কয়েকটি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি খুঁজে পাওয়ার কথা জানানো হয়। এগুলো দূর করতে সে সময় বেশকিছু সুপারিশও করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এরপর পাঁচ বছরের কাছাকাছি সময় পার হলেও বাস্তবায়ন হয়নি সুপারিশগুলো। সে সময় যেসব ভবনে ত্রুটিগুলো শনাক্ত হয়েছিল, তার মধ্যে গত বুধবার মধ্যরাতের পর শুরু হওয়া অগ্নিকাণ্ডের শিকার ৭ নম্বর ভবনটিও ছিল। রাত ২টার কিছু আগে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টার বেশি। আর তা পুরোপুরি নির্বাপণে সময় লেগে যায় ১০ ঘণ্টার কাছাকাছি। ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়েছে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি, কম্পিউটার ও আসবাব।

ফায়ার সার্ভিসের ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সচিবালয়ের ১ থেকে ৫ নম্বর পর্যন্ত পাঁচটি, ৭ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত চারটি এবং পরিবহন পুল ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। ভবনগুলোয় জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, ফায়ার লিফট ও আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভের ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো ফায়ার পাম্প সেট। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট কানেকশন, রাইজার ও হাইড্র্যান্টের মতো জরুরি সরঞ্জামাদির ব্যবস্থাও রাখা হয়নি ভবনগুলোয়। বহুতল ভবনের সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে প্রত্যেক ফ্লোরে সেফটি লবি থাকার কথা থাকলেও তা রাখা হয়নি। পাশাপাশি ভবনগুলোর তিনটি সাধারণ সিঁড়ির মধ্যে ছাদে খোলা রয়েছে শুধু একটি। কক্ষগুলোর দরজার সুইংও ত্রুটিপূর্ণ। নেই স্মোক ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম। ছাদে লাইটিং প্রটেকশন সিস্টেমও নেই।

বুধবার গভীর রাতের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ নম্বর ভবন নিয়ে দমকল বাহিনীর পর্যবেক্ষণে এসব ত্রুটির পাশাপাশি কোনো ফ্লোরেই সেফটি লবি না থাকার কথাও বলা হয়েছিল। সে সময় আরো বলা হয়, নির্মাণজনিত বিচ্যুতির কারণে সচিবালয়ের ছয়টি ভবনে (৪, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর এবং পরিবহন পুল ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ভবন) জরুরি মুহূর্তে উদ্ধার কার্যক্রমে বেগ পেতে হবে তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি সচিবালয়ে প্রবেশ ফটকে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ঢোকার মতো যথেষ্ট প্রশস্ততা না থাকার কথাও বলা হয়েছিল প্রতিবেদনে। অগ্নিনির্বাপণকারীরা জানিয়েছেন, বুধবার ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার পর তা নির্বাপণের জন্য সচিবালয়ের ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারেনি। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে দমকল কর্মীদের বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। এমনকি পানির সংস্থান করতে গিয়ে গতকাল একজনের প্রাণও গেছে।

৭ নম্বর ভবনটিতে অর্থ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে। চার বছর আগে দেয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে আগুনের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চার বছর আগে সচিবালয়ের ভবনগুলো পরিদর্শনের নেতৃত্ব দেন ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন উপপরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফায়ার সেফটি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চার বছর আগে সচিবালয়ে আমরা বেশকিছু মক ড্রিল করেছিলাম। ভবনগুলোর ত্রুটি নিয়ে তাদের বেশকিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে জলাধারের বিষয়টি বলা হয়েছিল। তাদের পর্যাপ্ত পানির উৎস থাকলে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হতো। এ পানি আনতে গিয়েই কিন্তু একজন ফায়ার ফাইটার প্রাণ দিলেন। সচিবালয়ে উত্তর পাশের নতুন গেটটি অনেক বেশি সংকুচিত। আমরা সে সময়ই তাদের বলেছিলাম কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ারের গাড়ি কিন্তু এ গেট দিয়ে প্রবেশ করানো সম্ভব হবে না। সচিবালয় দেশের হৃৎপিণ্ড। এখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষিত থাকে। আমরা পরে সচিবালয়ে একটি আধুনিক ফায়ার স্টেশন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেটি না দিয়ে আমাদের একটি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সচিবালয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এটি মোটেও এতগুলো ভবনের অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত নয়।’

ফায়ার সার্ভিসের ওই সময়ের পর্যবেক্ষণে অন্যান্য ভবনের ত্রুটির কথাও উঠে আসে। এর মধ্যে চারতলাবিশিষ্ট ৮ নম্বর ভবনটি সম্পর্কে বলা হয়, এখানে ৫০০ জনের জন্য সিঁড়ি রয়েছে মোটে একটি। এ সিঁড়ির প্রশস্ততা মাত্র সাড়ে তিন ফুট। ফলে জরুরি প্রয়োজনের সময় এখানে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। উপরন্তু সিঁড়িটি ছাদে খোলা নেই। ভবনটিতে কোনো জরুরি নির্গমন পথও নেই। দরজার সুইং ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া ভবনটির লাইটিং প্রটেকশন সিস্টেমও নেই। এ ভবনে রয়েছে ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দপ্তর। ৯ নম্বর ভবনে আলাদা আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভর থাকলেও নেই কোনো ফায়ার পাম্প সেট। স্থাপন করা হয়নি হাইড্র্যান্ট সিস্টেম বা রাইজারও। জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও নেই। পাশাপাশি মূল সিঁড়িটিও ছাদে খোলা হয়নি। নেই স্মোক ডিটেকশন সিস্টেম।

ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষণে সে সময় সবচেয়ে বেশি বিচ্যুতি পাওয়া যায় পরিবহন পুল ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ভবনে। এর মধ্যে একটি ১২ তলা, অন্যটি পাঁচতলা। এখানে আলাদা কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার নেই। ১২ তলার অংশে নেই কোনো জরুরি নির্গমন সিঁড়ি বা ফায়ার লিফট। ওঠানামার জন্য সিঁড়ি আছে মাত্র একটি। আর পাঁচতলা অংশে সিঁড়ি রয়েছে দুটি। এর মধ্যে ছাদে খোলা হয়েছে একটি। ভবন দুটির কোনোটিতেই স্মোক ডিটেকশন সিস্টেম নেই। ছাদে লাইটিং প্রটেকশন সিস্টেম নেই। পার্কিংয়েও পাওয়া যায়নি স্প্রিংকলার সিস্টেম।

এছাড়া সচিবালয়ের ১, ২, ৩, ৫ ও ১০ নম্বর ভবনেও নানা মাত্রার ত্রুটি পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তবে ভবনগুলো বহুতল না হওয়ায় অথবা কাঠামো ও জনসমাগম বিচারে ততটা আশঙ্কাজনক না হওয়ায় এসব ত্রুটি মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কম।

সচিবালয়ে গত বুধবার মধ্যরাতের পর শুরু হওয়া আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। তবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল জানিয়েছেন, ‘যেভাবে আগুন ছড়িয়েছে সেটা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কারণে হতে পারে। এক জায়গায় আগুন ধরলে বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে সব জায়গায় তা ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেও এ ঘটনা ঘটতে পারে। তবে তদন্ত শেষ না করে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না।’